Publisher
Published Date
24-10-2022
Edition
41th
Isbn
18153925
Country
Bangladesh.
Language
Bangla.
Pages
56
Price
TK 30.00
আশুরার শিক্ষা
মুহাররম মাসের ১০ তারিখ, যাকে আশুরা বলা হয়, একটি ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এ দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে দু’টি ঘটনা ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে। একটি হলো উদ্ধত জালিমের করুণ পরিণতি, আরেকটি হলো জালিম ও জুলুমের বিরুদ্ধে মাজলুমের আত্মত্যাগ এবং জীবন দিয়ে সত্যের পাতাকা সমুন্নত রাখার উজ্জল আদর্শ।
ফেরাউন ছিলো একজন উদ্ধত ও জালিম শাসক। যুগ যুগ ধরে এ ক্ষমতাদর্পী শাসক বানী ইসরাঈলের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করে কন্যা সন্তানদেরকে জীবিত রেখেছে। এ অহংকারী শাসক দাবী করেছিল, “আমিই তোমাদের মহান প্রভু”! এ ক্ষমতাধর জালিম স্বৈরশাসককে আল্লাহ তা‘আলা এদিনেই সলিল সমাধি করে চিরতরে নির্মূল করে তার জুলুমের নাগপাশ থেকে মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে নাজাত দিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা ফেরাউনকে দরিয়ায় ডুবিয়ে মেরেই ক্ষান্ত হননি অধিকন্তু তার মৃতদেহকে অদ্যাবধি সংরক্ষণ করে রেখেছেন। যাতে সে যুগে যুগে সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে যে, স্বৈরাচারী, দুর্বিনীত, জালিম শাসকদের পরিণতি কত ভয়াবহ ও করুণ হয়। এদিনে আরেক জালেম স্বৈরশাসক নমরুদের অগ্নিকুÐ থেকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর খলিল ইবরাহীম (আ) কে নিরাপদে নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন। এ ঘটনা থেকে অন্যায় ও স্বৈরাচারী জালিম শাসকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে যে, তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। বরং সময়ের ব্যবধানে তাদের পতন অনিবার্য এবং তাদেরকে এজন্য চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে। আর আখিরাতেও তাদের জুলুম ও অন্যায়ের কড়ায় গÐায় হিসাব দিতে হবে এবং কঠিন ও ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে। ন্যায় ও সত্যের পতাকাবাহী কাফেলার জন্যও এসকল ঘটনায় শিক্ষা রয়েছে। আর তা হলো জুলুম, নির্যাতন, সংকট প্রভৃতি সাময়িক। এক সময় এগুলোর অবসান হবে এবং জালিমের ধ্বংসাবশেষের উপর সত্যের বিজয় কেতন উড়বে।
আশুরার আরেকটি ঘটনা হলো কারবালার মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা। এখানে সত্যের পতাকাবাহী মাজলুমের রক্তে জালিমের হাত রঞ্জিত হয়েছে। রাসূলে আকরাম (সা) এর প্রিয় দৌহিত্র হোসাইন (রা) খিলাফতে রাশেদার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা ও সত্যের পাতাকাকে সমুন্নত রাখার জন্য সপরিবারে জীবন কুরবানী করেছেন। জীবন দিয়েছেন কিন্তু অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথানত করেননি। তাতে যুদ্ধে হোসাইন (রা) এর পরাজয় হয়েছে। কিন্তু জয় হয়েছে সত্যের, জয় হয়েছে আদর্শের, জয় হয়েছে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিবাদী দুর্বার চেতনার। যে চেতনা মজলুমকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়, আর জালিমের হৃদপিÐে সৃষ্টি করে কাঁপন। যে চেতনা বন্ধুর পথ, বাঁধার পাহাড় পাড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। যা একজন সত্য-ন্যায়ের পথিককে, একজন মুসলিমকে এ দৃপ্ত শপথে উদ্বীপ্ত করেÑ “জান দেগা, নেহি দেগা আমামা”। কারবালা ও ফোরাত শহীদদের রক্ত শোষে নি:শেষ করে দেয়নি, বরং তা প্রতিটি সত্যপন্থীর ধমনীতে প্রবাহিত করেছে, প্রাণ সঞ্চার করেছে মুসলিম ও ইসলামের। জনৈক কবি যথার্থই বলেছেন, “ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কি বাদ।”
কারবালার মূল শিক্ষা হলো, শত ঝড়-ঝাঞ্ঝার মধ্যেও সত্যের পথে অবিচল থাকা, প্রয়োজনে সে জন্য জীবন দেওয়া, তবুও অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। সত্যের জন্য, দ্বীনের জন্য যারা জীবন দেয় আল কুরআনের ভাষায় তারা অমর। তাদের জীবন দান কখনো বৃথা যায় না। বরং তারা চিরভাস্বর, চির অ¤øান, মানুষের মনে চিরজাগ্রত। আল্লাহর নিকটও তাদের মর্যাদা সমুন্নত। মনে রাখতে হবেÑ
জীবনের চেয়ে দ্বীপ্ত মৃত্যু তখনি জানি/শহীদী রক্তে হেসে উঠে যবে জিন্দেগানী
সুতরাং আশুরা মাতম আর বুক চাপড়িয়ে হায় হোসেন! হায় হোসেন! করার দিন নয়। বরং আশুরা অন্যায়, জুলুম, সন্ত্রাস ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দিন। বিশেষ করে বর্তমানে যখন গোটা বিশ্বের মুসলিমগণ এবং দুর্বল ও অসহায় জনগণ জালিমের যাতাকলে পিষ্ট, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নখর থাবায় ক্ষতবিক্ষত, মানবতা যখন বিধ্বস্ত, তখন আশুরার শিক্ষাকে ধারণ করে মানবতার মুক্তির জন্য সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই প্রতিটি বিবেকবান মানুষ, বিশেষ করে প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব। কাজেই বুক চাপড়ানো নয় বরং আশুরার মূল শিক্ষা বুকে ধারণ করতে হবে। আর তা হলো, “ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা”।<
হজ্জ ও কুরবানী
ড. মো: ছামিউল হক ফারুকী
হজ্জ
হজ্জ আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো ইচ্ছা ও সংকল্প। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ বা কা‘বা ঘর যিয়ারত করার ইচ্ছা ও সংকল্পকে হজ্জ বলা হয়। মুসলিমগণ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্দিষ্ট কেন্দ্র কা‘বা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করে বলে এর নামকরণ করা হয়েছে হজ্জ।
কা‘বা ও হজ্জ-এর প্রসঙ্গ আলোচনা করলে প্রাসঙ্গিকভাবেই ইবরাহীম (আ) এর নাম এসে যায়। কারণ তাঁর মাধ্যমে কা‘বা ও হজ্জ প্রতিষ্ঠা ও প্রবর্তন হয়েছে। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছরের বেশি পূর্বে তিনি ইরাকে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জাতি ছিল সে সময়ের সবচেয়ে উন্নত জাতি। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-ভাস্কর্যে তারা চরম উন্নতি লাভ করেছিল। কিন্তু নৈতিক ও আদর্শিকভাবে তারা ছিল চরম অধ:পতিত। এক আল্লাহকে পরিত্যাগ করে তারা সম্পূর্ণভাবে শিরকে লিপ্ত হয়ে পরেছিল। তারা চন্দ্র, সূর্য, তারকা এবং মাটি ও পাথর নির্মিত মূর্তির পূজা করত। বর্তমানকালের হিন্দু পÐিত ও ব্রাহ্মণদের মত তখনকার সমাজেও ঠাকুর পুরোহিতদের একটি শ্রেণী ছিল। যারা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পূজা-পার্বণ পরিচালনা করত। ইবরাহীম (আ)-যে বংশে জন্মগ্রহণ করেন, সেটিই ছিল পেশাদার ও বংশক্রমিক পূজারী। তাঁর বাবা-দাদা ছিল পুরোহিত ব্রাহ্মণ। পৌত্তলিকতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত এমন এক সমাজে জন্মগ্রহণ করেও ইবরাহীম (আ) শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি তদানিন্তন সমাজব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর স¤প্রদায় চন্দ্র, সূর্য, তারকা, মূর্তি প্রভৃতি যে সকল জিনিষের পূজা করেন সেগুলো পূজনীয় রব বা ইলাহ কিনাÑতা নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। পরিশেষে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এগুলোর কোনটিই রব বা ইলাহ নয়। তখন তিনি তাঁর জাতির সামনে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন,
إِنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ.
“তোমরা যাদেরকে (আল্লাহর সাথে) শরীক করো আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।”
তিনি আরো ঘোষণা করেন,
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا ۖ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ.
“আমি সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সে মহান সত্ত¡ার জন্য নিজেকে নিবিষ্ট করলাম, যিনি আকামসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই।”
এ বিপ্লবাত্মক ঘোষণার পর তার উপর বিপদ মুসিবতের পাহাড় নেমে আসে। পিতা তাঁকে ত্যাজ্য করে বাড়ী থেকে বের করে দেয়। তাঁর জাতি তাঁকে স্বদেশে থাকতে দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু ইবরাহীম (আ) এর কোনো পরোয়া না করে তাওহীদের উপর অটল থাকেন এবং নিজ হাতে মূর্তি ভেঙ্গে প্রমাণ করেন যে, এগুলো অসার এবং এগুলোর কোনো ক্ষমতা নেই। অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে বাদশার নিকট অভিযোগ দেওয়া হয় এবং বাদশা তাঁকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার দÐ প্রদান করেন। তাকে অগ্নিকুÐে নিক্ষেপ করা হলে, আল্লাহ নির্দেশ দেন,
يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ.
“হে আগুন, ইবরাহীমের জন্য ঠাÐা এবং শান্তিপ্রদ হয়ে যাও।” ফলে আগুন তাকে স্পর্শ করলো না এবং তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদে অগ্নিকুÐ হতে বের হয়ে শুধু নিজ স্ত্রী ও ভ্রাতুষ্পুত্রকে সাথে নিয়ে স্বদেশ ও স্বজনদের ছেড়ে চলে যান এবং নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচারের জন্য সিরিয়া, ফিলিস্তিন (কেনান), মিশর ও আরবদেশ সমূহে ঘুরতে ফিরতে লাগলেন।
ইবরাহীম (আ) এর একমাত্র চিন্তা ছিল দুনিয়ার মানুষকে শিরকের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর বান্দায় পরিণত করা। কিন্তু শিরকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত তদানিন্তন সমাজ এই একনিষ্ঠ তাওহীদবাদী মহাপুরুষকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। এ জন্য তিনি বছরের পর বছর উদভ্রান্ত পথিকের ন্যায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। কখনো কেনানের জনপদে কখনো মিশরে আবার কখনো আরবের মরুভূমিতে পৌঁছেছেন।
এভাবেই তার গোটা যৌবনকাল অতিবাহিত হয়ে গেল।
জীবনের শেষভাগে এসে তিনি তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্য একজন যোগ্য উত্তরসূরীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন এবং আল্লাহর কাছে একজন সৎ সন্তানের জন্য প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করে ৮৬ বছর বয়সে একটি পুত্র সন্তান দান করলেন। এ সন্তানের নাম ছিল ইসমাঈল। এবার ইবরাহীম (আ)-কে আরো কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হলো। সন্তানটি একটু বড় হলে তাকে নিজ হাতে কুরবানী করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিলেন। আল্লাহর খলিল ইবরাহীম (আ) আল্লাহর সে নির্দেশ পালনে সামান্যতমও কুণ্ঠিত হলেন না। তিনি নিজ হাতে প্রিয় সন্তানকে কুরবানী করতে উদ্দত হলেন। আল্লাহ তা‘আলা বেহেশতী একটি দুম্বাকে ইসমাঈলের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং সেটিই কুরবানী হয়ে যায়। এখান থেকে কুরবানীর বিধান প্রবর্তন করা হয়।
ইবরাহমী (আ) ছিলেন মুসলিম মিল্লাতের জনক। (مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ ۚ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত, তিনিই তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।’ এভাবে ইবরাহীম (আ) যখন সকল পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হলেন তখন আল্লাহ তাঁকে বিশ্বমানবতার নেতা হিসেবে মনোনীত করলেন।